আজকের দিবসটি তখনও শুরুই হয়নি। অর্থাৎ গতকাল রাতেই আমার খুব কাছের একজনের ম্যাসেজ পেলাম। ম্যাসেজে তিনি বললেন, ‘আগামীকাল বিশ্ব নারী দিবস। আশা করবো, এই বিষয়ে অর্থাৎ নারী দিবস উপলক্ষে আপনি কিছু লিখবেন।’ আর তখন থেকেই মনের গহীনে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু ‘প্রয়োজন আইন মানে না’ বলে প্রবাদে একটা কথা আছে।প্রয়োজনের তাগিদে অত্যন্ত ব্যস্ততায় সময় কাটাতে হয়েছে। আজ সকালের অর্থাৎ ৮ মার্চ’র সূর্যোদয়টাই নিজ এলাকায় থেকে দেখা হবে, এমনটাও ছিলো অনিশ্চিত। সঙ্গত কারণেই ইচ্ছে থাকলেও কিছু করা হবে ভাবিনি। এমনকি ভালোমতো ফেসবুকে ঢু মারবার মতোও পাইনি ফুরসৎ। অবশেষে প্রয়োজনীয়তা সমাপনান্তে ফেসবুকে এসে দেখি,এখানে আরো অবাক করার মতোই সব কাণ্ড কারখানা! আজ যেনো সবাই নতুন করে ‘নারীবাদী’ হয়ে গেলেন! তাহলে কি এই সমাজে পুরুষবাদী কেউ-ই নেই? হ্যা, নারীবাদী হতে অবশ্য কোনোই দোষ নাই। কিন্তু কেবল ওই একটা দিবসই-বা কেনো?
আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসের সূচনা হয়েছিলো বহু আগে। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ মজুরি-বৈষম্য এবং কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সূতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। এই প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের ওপর দমন-পীড়ন চালায় মালিকপক্ষ। এমনি নানানতর ঘটনার পরই ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীতে সমাজতান্ত্রিক নেত্রী এবং রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্ব প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এর ধারাবাহিকতাতেই ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন-এ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। গোটা বিশ্বের ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী প্রতিনিধি ওই সম্মেলনে যোগদান করেন। সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নারীর সমঅধিকার দিবস হিসেবেই দিনটি পালিত হবে। এরপর দিবসটিকে পালনে এগিয়ে আসে সমাজতন্ত্রীরা। ফলে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশেও একাত্তরে স্বাধীনতার লাভের পূর্ব থেকেই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক শিবিরে অবশ্য দিবসটিকে পালন করা হতো বেশ ঘটা করেই। রুশ বা রাশিয়া বা সোভিয়েত বিপ্লবের পর থেকে সমাজতান্ত্রিক শিবিরগুলোতে নারী মুক্তি আন্দোলনের অনুপ্রেরণাদায়ক দিন হয়েই দাঁড়ায় ‘নারী দিবস’।
এভাবেই কেটে যায় অরো কয়েকটি দশক। অবশেষে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জাতিসংঘ। এভাবেই কেটে যায় আরো খানিকটা সময়। অত:পর ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে রাষ্ট্রসংঘ তথা জাতিসংঘ। শুধু তাই নয়, দিবসটিকে পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহবানও জানায় জাতিসংঘ। আর সেই থেকেই বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হয় নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তাবত মানব সমাজের অগ্রগামীতাও বিশ্লেষণ করা হয় আজকের এ দিনটিতে।
ইতিহাসে নারী দিবসের উল্লেখ্যযোগ্য দিন
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরে সেলাই কারখানার নারী শ্রমিকরা রাস্তায় নামেন।
১৮৬০’র ৮ মার্চ নারী শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে দাবী আদায়ে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠনে ব্যর্থ হয়।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সের প্যারিসে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন নারীর সম অধিকার দাবী জোরালো করেন।
১৯০৭-এ জার্মানির স্টুটগার্টে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০জন প্রতিনিধি নিয়ে হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন।
১৯১১-তে সম্মেলনের সিদ্ধান্তমতে ৮ মার্চ ‘নারীর সমঅধিকার দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মার্চ সুইজারল্যাণ্ড, ডেনমার্ক, অষ্ট্রিয়া ও জার্মানিতে লক্ষাধিক নারী প্রথমবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেন।
১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কিছু দেশে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস রূপে পালিত হতে থাকে।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে সানফ্রান্সিসকোতে নারী অধিকারের যৌক্তিক দাবী বিবেচনায় ‘জেণ্ডার ইকুয়ালিটি’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন রাষ্ট্রসংঘ।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতিদানে এগোয় রাষ্ট্রসংঘ।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত ‘৮ মার্চ নারী দিবস’ বিল অনুমোদন পায়।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ ঘোষণা করে। ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ।
বাংলাদেশে নারী উন্নয়নকে বেছে নেয়া হয়েছে টেকসই উন্নয়নের পথ হিসেবে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতেও ক্রম থেকে ক্রমান্বয়েই বাড়ছে নারীর ভূমিকা। সময়টা গত দুই যুগেরও অধিক থেকে চলছে। আমাদের দেশের সরকারপ্রধান এবং বিরোধীদলীয় প্রধানের পদও নারী রাজনীতিকদের করতলে। এই মুহূর্তে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় সংসদের স্পীকার, অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পদে যিনারা আছেন ওনারা সকলেই নারী। তথাপিও দেশের ৮০ ভাগ নারীই কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার শিকার! এহেন সহিংসতার ঘৃণ্যতম অভ্যেস থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে কি আদৌও নারী উন্নয়ন সম্ভব?
আমরা সকলেই রাষ্ট্রের নাগরিক। তবে এটা বেশ পরে, সর্বাগ্রে আমরা কোনো না কোনো পরিবারেরই সদস্য। আর এই পরিবারকেই বলা হয় সকল শিক্ষার প্রাথমিক তথা অন্যতম আধার। অথচ বাস্তবিকে আমরা সেখানে কেমনতর শিক্ষাটাই-বা পেয়ে থাকি! শিশুকাল থেকে আজকে অবধি আমার মা-বোনদের আচার-আচরণ পর্যালোচনা করে এমনটাই পেয়েছি যে, ‘একজন নারীই আরেকজন নারীর উন্নয়নের পথে প্রধানতম বা অন্যতম অন্তরায়।’ বিষয়টি আরো সহজে বলতে গেলে, ‘একজন নারীই আরেকজন নারীর সবচে’ বড় শত্রু।’
কিছু প্রশ্ন মনের গভীরে থেকেই যায়। নারী দিবস মানেই কি কেবলই সভা-সেমিনার-মানববন্ধন এজাতীয় কিছু কর্মসূচির আয়োজন? সত্যিকারার্থে এই আমরা নারীর মর্যাদা রক্ষা করার ক্ষেত্রে কতোখানি আন্তরিক? মোদ্দা কথা হচ্ছে, ‘বধূ মাতা কন্যা’ এই তিনটা স্তরেই জগতের তাবত পুরুষের আধার। আর এই তিনই হচ্ছেন নারী। তাই আজকের এই দিনে জগতের সকল নারীর প্রতিই রইলো প্রগাঢ় শুভ কামনা।
লেখক- এইচ.এম. সিরাজ : কবি, সাংবাদিক ও শিক্ষানবিশ অ্যাডভোকেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। নির্বাহী সম্পাদক- দৈনিক প্রজাবন্ধু, গ্রন্থাগার সম্পাদক- ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব
লিপিকাল : ০৮ মার্চ, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ
Leave a Reply